আহমেদ সাব্বির রোমিও।।
লাইট , ক্যামেরা, অ্যাকশন- দিনরাত শুটিংয়ে মেতেছেন দিনের পর দিন। অভিনেত্রী বলেই হয়তো অনেক আত্মীয়-স্বজনের কাছে বাড়তি আগ্রহের প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। সেই তাজিন আহমেদকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো চরম হতাশা নিয়ে! জীবনের শেষ সময়গুলো চরম একাকী ছিলেন এক সময়ের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী ।
রাজধানীর বনানী কবরস্থানে কামাল উদ্দিন আহমেদের কবরে শায়িত করা হয়েছে অভিনেত্রী তাজিন আহমেদকে। গতকাল বুধবার বাদ জোহর গুলশানের আজাদা মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে তাজিনকে দাফন করা হয়। বৃষ্টির মধ্যে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় বিনোদনজগতে তার সহকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন।
এর আগে সকালে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের হিমঘর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাজিনের মরদেহ গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। সেখানে বন্দি মা দিলারা জলিকে তাজিনের লাশ দেখানো হয়। এ সময় মেয়ের লাশ দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। কিছু সময় পর তাজিনের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। পরে সকাল সাড়ে ১০টায় উত্তরার আনন্দবাড়ি শুটিং স্পটে তার লাশ রাখা হয়। সেখানে তাজিনের সহকর্মী ও বিনোদন জগতের অনেকেই তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসেন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সেখানে লাশ রাখার পর জানাজার জন্য গুলশানে নিয়ে আসা হয়।
তাজিন আহমেদের জন্ম ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই নোয়াখালী জেলায়। তার বাবার নাম মরহুম কামাল উদ্দিন আহমেদ (দুলু) আর মা দিলারা জলি। চার বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। বেড়ে উঠেছেন পাবনা জেলায়, নানা বাড়িতে। ১৯৯২ সালে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।
শোবিজ ও লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিলো তার দারুণ। সেই সুবাদে নাম লিখিয়েছিলেন অভিনয়, উপস্থাপনা ও সাংবাদিকতায়। ১৯৯১ সালে বিটিভিতে ‘চেতনা’ নামের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থাপনা শুরু করেন তাজিন আহমেদ। এনটিভিতে প্রচারিত ‘টিফিনের ফাঁকে’ অনুষ্ঠানে টানা ১০ বছর উপস্থাপনা করেন তিনি। একাত্তর টিভিতে ‘একাত্তরের সকাল’ অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছেন। তবে শোবিজ যাত্রায় তাজিন আহমেদের অভিনয়ের শুরুটা হয় টিভি নাটক দিয়ে। বিটিভিতে তার অভিনীত নাটক ‘আঁধারে ধবল দৃপ্তি’ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত নাটক ‘নীলচুড়ি’তে অভিনয় করে প্রশংসিত হন তাজিন আহমেদ।
অভিনয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে ১৯৯৭ সালে মঞ্চ নাটকে যোগ দেন তাজিন। থিয়েটার আরামবাগ দিয়ে মঞ্চ যাত্রা হয় তার। এরপর নাট্যজন থিয়েটারের হয়ে কিছু নাটকে অভিনয় করেন। পরে আরণ্যক নাট্যদলের ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। এটি তার অভিনীত শেষ মঞ্চনাটক ছিলো। আর টিভিতে তার অভিনীত শেষ ধারাবাহিক নাটক ছিলো ‘বিদেশি পাড়া’।
লেখালেখিতেও দক্ষ ছিলেন তাজিন আহমেদ। পরিচালনাতেও নাম লিখিয়েছিলেন। তার লেখা ও পরিচালনায় তৈরি হয় ‘যাতক’ ও ‘যোগফল’ নামে দুটি নাটক। তার লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’, ‘অনুর একদিন’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘হুম’, ‘সম্পর্ক’ ইত্যাদি।
২০০২ সালে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে যোগ দেন। গেল বছরে ববি হাজ্জাজের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) দলে যোগ দিয়েছিলেন তাজিন। পেয়েছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সম্পাদক (সাংস্কৃতিক) পদ।
তাজিনের শেষ পোস্টে কী ছিল?
‘ভালো লাগা মুহূর্তগুলো সব সময় স্মৃতি হয়ে যায়…’সোমবার দিবাগত রাতে ফেসবুকে এটি পোস্ট করেছিলেন অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপক তাজিন আহমেদ। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি নিজেই সবার কাছে স্মৃতি হয়ে গেলেন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এমন কথা লেখার ১২ ঘণ্টার মাথায় তিনি নিজেই স্মৃতির খাতায় নাম লেখালেন। দাম্পত্যজীবনেও খুব একটা সুখী হতে পারেননি তাজিন। প্রথম জীবনে তাজিন আহমেদ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন নাট্য নির্মাতা এজাজ মুন্নাকে। খুব বেশিদিন টেকেনি সেই সংসার। এরপর তিনি বিয়ে করেন একজন মিউজিশিয়ানকে। এই সংসারেও ঝামেলা ছিলো। শেষ জীবনে একাকী জীবন কাটছিল তার। জীবনপ্রদীপ নিভে যাবার আগে দ্বিতীয় স্বামীকেও পাশে পেলেন না তাজিন । বিচ্ছেদের পর তার মেকাপ আর্টিস্টই তাকে দেখাশোনা করতেন। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় একা বসবাস করে আসছিলেন তিনি। মোহাম্মদপুরের নিজেদের পৈত্রিক বাড়িটিও হাতছাড়া হয়ে যায় পারিবারিক প্রতিহিংসার কারণে বহু আগেই। মা দিলারা জলির প্রোডাকশন হাউজ ছিল। মা দিলারা জলি চেক ডিজঅনারের একটি মামলায় দুই বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন। আগামী ১২ জুন ২০১৮ তার মুক্তি পাবার কথা ছিল। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! মায়ের মুক্তির আগেই এই দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিলেন হতভাগ্য এই অভিনেত্রী ।
শেষ জীবনে পরিবার-পরিজন থেকে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অভিনয় জগতের প্রিয় অঙ্গনের সঙ্গেও ছিল দূরত্ব। অল্প কিছু প্রিয় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হলেও সেটা মুঠোফোন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল। বেশ নীরবে নিভৃতেই কেটেছে তার শেষ দিনগুলো। সেগুলো যে বিষাদময়, যাতনাময় ছিল তার প্রমাণ দেয় তাজিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো।
চরম হতাশা নিয়েই বিদায় নিলেন অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ !
